বর্ষা মৌসুম। তবু নদীতে পর্যাপ্ত পানি নেই। নানা কারণে বিলুপ্তির পথে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ। আবহমান গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তবে গ্রামবাসীর উদ্যোগে এখনো হচ্ছে সুস্থ বিনোদনের এই উৎসব। এক সময় বর্ষায় নৌকা বাইচ ছিল দেশের প্রধান উৎসব। প্রতি বছর বর্ষাকালে ভরা ভাদ্রে এ উৎসব পালিত হতো। এখন সেটা আর নেই। তবে একেবারে নেই সেটা বলা যাবে না।
থৈ থৈ পানি, মাঝি-মাল্লার বৈঠার ছন্দ আর লাখো দর্শনার্থীর হৈ হৈ রব, কাঁশি-বাঁশি আর ঝাঁজরের সুর, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আর দর্শনার্থীর করতালিতে মুখোরিত হয়ে ওঠে ইছামতি নদীর দুই তীর। ঝাঁজ ও কাঁশি বাজিয়ে নৌকার দলনেতা সতীর্থদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও উৎসাহ জোগান।
বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির প্রাচীনতম এ উৎসব উপভোগ করতে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠে আনন্দে-উল্লাসে। নদীর পাড়ে বসে গ্রাম্যমেলা।
আল্লায় বলিয়া নাও খোলরে ভাই সক্কলি। আল্লাহ বলিয়া খোলো। ওরে আল্লা বল নাও খোল শয়তান যাবে দূরে। ওরে যে কলমা পইড়া দেছে মোহাম্মদ রাসূলরে ভাই সক্কল’ এই সারি গানের তালের ঝোঁকে ঝোঁকে বৈঠা টানের মধ্যদিয়ে রোববার ঢাকার নবাবগঞ্জে ইছামতির কলকোপা পয়েন্টে গ্রাম বাংলার শত বছরের ঐতিহ্যের নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটি, নবাবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, নবাবগঞ্জ থানা পুলিশ, কলাকোপা ও যন্ত্রাইল ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় এই বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। পরে কলাকোপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো:ইব্রারাহিম খলিলের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল ইসলামের সঞ্চলনায় এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বলেন, আমাদের এই বাইচ কমিটি দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় যেসব স্থানে আগে নৌকা বাইচ হতো। কিন্তু বর্তমানে নানা কারণে বন্ধ আছে। সেসব এলাকার আয়োজকদের বাইচ আয়োজন করতে উদ্বুদ্ধ করি। তিনি বলেন, বাইচ আয়োজন এখন অনেক ব্যয় বহুল। সরকারের পক্ষ থেকে ফুটবল, ক্রিকেট খেলার আয়োজন করলেও নৌকা বাইচ আয়োজনও করা হয় না। এমনকি কোনো সহযোগিতাও করে না। তবে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় এখনো নৌকা বাইচ আয়োজন করা হচ্ছে। আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করছি প্রতিটি জেলা উপজেলায় একটি করে নৌকা বাইচ আয়োজনের।
নৌকার দলনেতা ঝাঁজ ও কাঁশি বাজিয়ে সতীর্থদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ও উৎসাহ জোগান। বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতির প্রাচীনতম এ উৎসব উপভোগ করতে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধসহ নির্বিশেষে সকলেই মেতে ওঠে আনন্দে-উল্লাসে। নৌকা বাইচে ঢাকা, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৬টি ঘাসী নৌকা অংশগ্রহণ করেন।
রুপগঞ্জ থেকে আসা এক বৃদ্ধ বলেন, অনেক বছর পর এই নৌকা বাইচ দেখতে আসলাম। ঐতিহ্যবাহী এই নৌকা বাইচ দেখে অনেক ভালো লাগলো। তবে প্রতি বছরই যদি এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো তাহলে অনেক ভালো হতো। কারণ বর্তমান সময়ে এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হারিয়ে যাচ্ছে। তার মতো আরও অনেকে দর্শনার্থী নদীর দুই কূলজুড়ে নৌকা বাইচ দেখতে লাখো দর্শনার্থী উপস্থিত হয়। ঢাকাসহ আশপাশের মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকার দর্শনার্থীরা তাদের পরিবার নিয়ে এ নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে উপস্থিত হন। এ সময় নদী পাড়ে আসা দর্শনার্থীদের মধ্যে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখা গেছে।
সরজমিন নৌকা বাইচ উপলক্ষে নদীর দুই তীরে হাজারো দর্শনার্থীর উপস্থিতি দেখা গেছে। সেখানে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মেলা। স্থানীয়রা বলছেন, নৌকা বাইচ উপলক্ষে তাদের বাড়িতে এসেছে নতুন অতিথি। বাড়িতে বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছে নানা মুখরোচক খাবারের। এমন আয়োজনে খুশি তারা। নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি মাসুদ মোল্লা বলেন, আমরা প্রতি বছর অনেক কষ্ট করে নৌকা বাইচ ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে বাইচের আয়োজন করি। কিন্তু বর্তমানে নদীতে পানি কম থাকার কারণে ও কচুরিপানার কারণে আগের মতো নৌকা বাইচ আয়োজন করতে পারি না। সরকারের পক্ষ থেকে নদীর কচুরিপানা মুক্ত করতে সহায়তা করলে আরও নৌকা বাইচ আয়োজন করতে পারবো। নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি মাসুদ রানা বলেন, আমাদের বাইচে ৭টি নৌকা অংশ গ্রহণ করেছে। নৌকাগুলো হলো শিকদার বাড়ি
খান বাড়ি,লিটন-১, লিটন-২, সোনার তরী, দাদা নাতি মোহন মন্ডল, শেখ আব্দুল খালেক।
আয়োজক কমিটির সভাপতি মো. ইব্রাহিম খলিল জানান, নৌকা বাইচ ঐতিহ্য রক্ষা জাতীয় কমিটির দাবির প্রেক্ষিতে গ্রামবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় ৩০ বছর পর ইছামতীর কলাকোপা পয়েন্টে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হলো। আগামীতেও এমন নৌকা বাইচের আয়োজন হবে