Search for:

বর্তমান সমাজে নানা রকম সমস্যা আর অরাজকতা প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতারণা, দুর্নীতি, অবিচার—সব মিলিয়ে আমাদের চারপাশটা যেন এক বিশৃঙ্খল জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে অনেকেই ভাবেন, সমাজের নিয়মগুলো এমনই, তাই নিজেকেও হয়তো তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এই চিন্তা কি সঠিক?

আমরা যখন আমাদের চারপাশের জগৎকে পর্যবেক্ষণ করি, তখন দেখতে পাই যে অনেক ক্ষেত্রে সমাজের একটি বড় অংশ নীতি, মূল্যবোধ, এবং ন্যায়ের ধারণা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে এমন একটি ধারণা প্রচলিত হচ্ছে যে সমাজের এই পশুরূপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হলে আমাদেরও পশুর মতো আচরণ করতে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের চিন্তা আমাদের মানবিক গুণাবলির সাথে সাংঘর্ষিক। সমাজ যদি সত্যিই জঙ্গলে পরিণত হয়, তবে আমাদের উচিত সেই জঙ্গলে আশার আলো হয়ে ওঠা, একে পরিবর্তনের পথে নিয়ে যাওয়া।

একটি সুস্থ সমাজের মূল ভিত্তি হলো নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, আর মানবিকতা। আমাদের বিবেক আমাদেরকে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য শেখায় এবং নৈতিকতার পথে চলতে সাহায্য করে। এই নীতিবোধ এবং আদর্শ ধরে রাখাই আমাদের মানবিকতার পরিচয় বহন করে। সমাজের দুর্নীতি, অবিচার, কিংবা অন্যায় আচরণের কারণে আমরা যদি নিজের নীতি ও আদর্শকে ভুলে যাই, তবে আমরা আমাদের প্রকৃত মানবিক পরিচয় হারিয়ে ফেলব। কারণ, আমাদের আদর্শিক পথে অবিচল থাকা এবং মানবিক গুণাবলি রক্ষা করা ব্যক্তিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

সত্যিকার অর্থে, যখনই সমাজে অরাজকতা বৃদ্ধি পায়, তখন সঠিক মানুষ এবং আদর্শবান ব্যক্তিদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। এমন সমাজে তারা আলোর মশাল হয়ে ওঠেন এবং সঠিক পথ দেখানোর দায়িত্ব পালন করেন। এমন পরিস্থিতিতে সৎ থাকার চেষ্টা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এটি তখনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক সময় মনে হতে পারে যে সমাজের প্রবাহের সঙ্গে মিশে যাওয়াই হয়তো সহজ। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমাদের মানবিক গুণাবলিই আমাদেরকে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে।

পশুর সমাজে কোনো নীতির ধারণা নেই; শক্তিশালীই টিকে থাকে, এবং দুর্বলদের পদদলিত হতে হয়। কিন্তু মানুষের সমাজ কেবল শক্তির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি; এটি গড়ে উঠেছে নৈতিকতা, সহানুভূতি, সহযোগিতা, এবং মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে। তাই সমাজ যখন জঙ্গলে পরিণত হয়, তখনও আমাদের উচিত পশুর মতো আচরণ না করা। আমাদের উচিত আমাদের বিবেক ও মানবিকতার পথকে আঁকড়ে ধরা। কারণ, সমাজ পরিবর্তন হয় মানুষের আচরণের দ্বারা।

আমাদের সমাজের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে দেখা গেছে যে কিছু ব্যক্তির নৈতিক সাহস এবং আদর্শই বহু সমাজকে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছে। মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র প্রমুখ ব্যক্তিত্ব সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের আদর্শে অবিচল ছিলেন। তাঁরা অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা কখনও তাঁদের মানবিক গুণাবলিকে বিসর্জন দেননি। তাঁদের এই অবিচলতা কেবল তাঁদের ব্যক্তিগত জয় নয়, বরং সমাজের পরিবর্তনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।

সমাজে অন্যায় ও অবিচার দেখতে দেখতে আমরা অনেকেই মনে করি, এটাই হয়তো জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ। কিন্তু এটি আসলে মানব সভ্যতার এক ধরনের মিথ্যা ধারণা। জীবনের আসল উদ্দেশ্য হলো ন্যায় এবং সত্যের পক্ষে থাকা, মানবিকতা ও সহানুভূতির চর্চা করা। সমাজের অবক্ষয় আমাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ পরিবর্তনের কারণ হতে পারে না। বরং আমাদের উচিত এই অবক্ষয়ের বিপরীতে দাঁড়ানো এবং আমাদের মূল্যবোধকে রক্ষা করা। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে আদর্শের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

সমাজের অবক্ষয়ের কারণে যদি আমরা নিজেরাই পশুর মতো আচরণ করতে শুরু করি, তবে সমাজের পরিবর্তন কখনও সম্ভব হবে না। বরং, সমাজের অবক্ষয়ের সময় আরও বেশি প্রয়োজন নিজেদের মানসিকতা ঠিক রাখা এবং অন্যদেরকে পথ দেখানো। যে সমাজ পশুর মতো আচরণ করে, সেখানে কিছু মানুষ যদি আলোর পথ ধরে, তাহলে সেই সমাজের পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। এটি হয়তো দীর্ঘ এবং কঠিন প্রক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু এটি সম্ভব। কারণ, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন হয় কিছু মানুষের অদম্য নৈতিক সাহস।

আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায় এবং অবিচারকে মেনে না নিয়ে, আমাদের উচিত তা প্রতিহত করার চেষ্টা করা। আমরা যদি নিজেদের আদর্শ বজায় রেখে জীবন যাপন করি, তাহলে অন্যরাও সেই পথে চলার অনুপ্রেরণা পাবে। সমাজের পরিস্থিতি যেমনই হোক, আমাদের মানবিক গুণাবলিকে ধরে রাখাই হবে সত্যিকার মানবিকতার পরিচয়।

শেষ কথা হলো, সমাজ যদি সত্যিই জঙ্গলে পরিণত হয়ে যায়, তবে আমাদের উচিত সেই জঙ্গলে এক টুকরো আশার আলো হয়ে থাকা। কারণ, জঙ্গল কেবলমাত্র শক্তির নিয়মে চলে, কিন্তু আমরা মানুষ। আমাদের বিবেক, আদর্শ, আর মানবিকতার ভিত্তিতে পৃথিবীকে সুন্দর করার ক্ষমতা রয়েছে।

Leave A Comment

All fields marked with an asterisk (*) are required