কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফে গত ৬ মাসে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ৬২ জনকে। টেকনাফের তিনটি ইউনিয়ন হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় মূলত এসব অপহরণের ঘটনা ঘটছে। এ সব এলাকায় গত এক বছরে মাদকের চালান জব্দের ঘটনা কয়েক গুণ বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর মতে, ইয়াবা ও আইস (ক্রিস্টাল মেথ) মাদক পাচারের ঘটনা বাড়ার সঙ্গে এসব অপহরণের যোগাযোগ রয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিপণ আদায়ে অপহরণের জন্য সন্ত্রাসীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তু ইয়াবা কারবারি অথবা তাঁদের আত্মীয়স্বজন। এর পাশাপাশি এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরা অপহরণের শিকার হয়েছেন।
টেকনাফের এসব অপহরণের ঘটনায় যে ইয়াবার সংশ্লিষ্টতা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তা স্বীকার করেছেন। গত বুধবার বিকেলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং ইয়াবা কারবারিদের আইনের আওতায় আনা গেলে অপহরণসহ নানা অপরাধ বন্ধ হবে।
টেকনাফের কলেজশিক্ষক ও হ্নীলার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ইয়াবা কারবারিদের ধরে নিতে পারলে মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কে ইয়াবা ব্যবসা করেন, তাঁদের অবস্থান জানা থাকে সন্ত্রাসীদের। মাঝেমধ্যে ভুল তথ্যে সাধারণ ও গরিব কৃষকদের অপহরণ করা হয়। এই কলেজশিক্ষকের মতে, ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ হলে সামাজিক অস্থিরতা ও অপহরণের মতো অপরাধও বন্ধ হবে।
হ্নীলা ইউনিয়নের মানুষজনের কাছে অপহরণ এখন বড় আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ওই ইউনিয়নে সাত কিশোরসহ অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে হ্নীলার জাদিমোরার নেচার পার্ক এলাকা থেকে পাঁচ রোহিঙ্গা কিশোর অপহৃত হয়। এরা সবাই হ্নীলা ইউনিয়নের নয়াপাড়া আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে এসব কিশোরকে মুক্ত করে আনা হয়েছে বলে তাদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
এর আগে গত ২৬ মার্চ নেচার পার্ক এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছিল হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া এলাকার দুই কিশোর। এক দিন পর সন্ত্রাসীদের চার লাখ টাকা দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় তাদের। কিন্তু অপহরণের এই দুই ঘটনায় থানায় মামলা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় মাসে মুক্তিপণের জন্য ৩ ইউনিয়নের ৫৭ জন স্থানীয় বাসিন্দা ৫ জন রোহিঙ্গা কিশোর অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩৯ জন থেকে আদায় হয়েছে অর্ধকোটি টাকার মুক্তিপণ।
টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ অপহরণের ঘটনা মাদককে ঘিরে হচ্ছে। যাঁরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসছেন, তাঁদের কেউ থানায় অভিযোগ করছেন না। তাঁদের অনেকের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকও জড়িত আছেন।
টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২২ সালের ১ নভেম্বর থেকে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে টেকনাফ থানায় অপহরণের মামলা হয়েছে সাতটি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪৬। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩ জনকে। একই সময়ে অপহৃত ২৩ জনকে উদ্ধার করে পুলিশ। অবশিষ্ট ৩৯ জন নিজ উদ্যোগে বাড়ি ফেরেন।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে ভুগছেন। অতীতে গ্রামের চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল।
উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া, জাদিমোরা, লেদা, আলীখালি, রঙ্গীখালী, পানখালী, কম্মুনিয়াপাড়া ও মরিচ্চ্যঘোনা এলাকার মানুষ অপহরণ আতঙ্কে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন হ্নিলার ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী। এলাকাগুলোতে ইয়াবার কারবারও বাড়ছে।
গত বছরের ১১ ডিসেম্বর টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ২ কেজি ১২৮ গ্রাম আইস মাদক ও ২০ হাজার ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি।